চাটগাঁইয়া ভাষা উপভাষা নয়, স্বতন্ত্র ভাষা।
চাটগাঁইয়া ভাষা উপভাষা নয়, স্বতন্ত্র ভাষা।
চাটগাঁইয়া ভাষা উপভাষা নয়, স্বতন্ত্র ভাষা। এটাকে উপভাষা বলে যারা প্রচার করেছেন, বিশেষ করে, জর্জ গ্রিয়ার্সন, জে ডি এন্ডার্সন, সুনীতিকুমার, মনিরুজ্জামান, তারা নিজেরাও স্বীকার করেছেন, চাটগাঁইয়া ভাষা স্বতন্ত্র ভাষা হওয়ার যোগ্য।
অন্যদিকে চাটগাঁইয়া আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ এবং সাংবাদিক মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকী এটাকে স্বতন্ত্র ভাষা বলেই গণ্য করেছেন। যদিও তারা গ্রিয়ার্সন ও সুনীতিকুমারের প্রস্তাবনাকে সরাসরি নাকচ করেন নি। ড. শ্যামল নিজেও একই কলোনিয়াল ক্ষুরে মাথা কামিয়েছেন। মানে, তিনিও এই ভাষাকে বাংলার উপভাষা গণ্য করেছেন।
যদি আমরা দেখি, কেন গ্রিয়ার্সন চাটগাঁইয়া ভাষাকে উপভাষা বলে অনুমান করেছেন। তাহলে দেখবো আসলে তার যুক্তির ভিত্তি দুর্বল।
জর্জ গ্রিয়ার্সন ভারতীয় ভাষা জরিপের কাজে চাটাগাঁইয়া বুলি বিষয়ে পরের মুখে ঝাল খেয়েছিলেন। চাটগাঁইয়া ভাষার জরিপটি করেছিলেন চিটাগাং এর তৎকালীন ডিসি জে. ডি. এন্ডার্সনের মাধ্যমে। চাটগাঁইয়া ভাষার প্রতি জে ডি এন্ডার্সনের আগ্রহের কমতি ছিল না। বলা বাহুল্য চাটগাঁইয়া ভাষার প্রবাদ-প্রবচন নিয়ে লেখা প্রথম বইটি জে ডি এন্ডার্সনের। তারপরও আমাদের স্বীকার করতে হবে, ভাষাজরিপের ক্ষেত্রে চাটগাঁইয়া ভাষাকে বাংলার আঞ্চলিক বুলি বলার যে ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতি, সেটা সোজা কথায় ভাষার আমলাতন্ত্র। প্রশাসনিক ক্রমসোপানের আদলে ভাষা ও সংস্কৃতির ক্রমসোপান নির্ধারণ করতে গিয়ে গ্রিয়ার্সন ও জে ডি এন্ডার্সন উভয়েই ভাষার ওপর পূর্বতঃসিদ্ধ ক্ষমতাকাঠামো চাপিয়ে দিয়েছেন। ভাষা ও সংস্কৃতির একচুয়াল অরিজিন বিবেচনা না করে, সমকালীন ভাষা পরিস্থিতির আলোকে চাটগাঁইয়া বুলিকে বিবেচনা করেছেন। ফলে ভাষা এবং, সেই অর্থে, শব্দের ব্যুৎপত্তি ও উচ্চারণ সংক্রান্ত বিবেচনা, তাদের ক্ষেত্রে, একটি বৈকল্পিক বিবেচনা; চূড়ান্ত বিবেচনা নয়। যে ওরিয়েন্টালিস্ট গেজ থেকে, ক্ষমতার যে টাওয়ার থেকে, তারা চাটগাঁইয়া ভাষাকে দেখেছেন, তা প্রান্তিক ভাষাকে প্রান্তিক প্রতিষ্ঠানের মতোই অধস্তন ভাবার জায়গা। ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও প্রান্ত উৎপাদনের এই আমলাতন্ত্র জন্ম নিয়েছিলো খোদ কোম্পানি আমলের ঔপনিবেশিক প্রভুদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে।
তারা যখন এই জরিপ করছেন তখন চিটাগাং সার্বিক অর্থেই কলকাতাকেন্দ্রিক ক্ষমতাবলয়ের অধীন। কাজেই বাংলাকে কেন্দ্র ধরেই অপরাপর ভাষার ক্রমঅবস্থান হিসেব করা হয়েছে। অথচ আমির খসরু, যিনি জাতিতে তুর্কী, ভাষার অঞ্চলভেদে স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করেছেন। সিন্ধি, গুজরাটি, তামিল, লাহোরি, বাংলা, ইত্যাদি ভাষা তার স্ব স্ব অঞ্চল ভেদে স্বতন্ত্র ভাষা।
ইতিপূর্বে আলবেরুণী (১০৩০ খ্রিস্টাব্দ) এবং আমির খসরু (১৩১৭ খ্রিস্টাব্দ) ভারতীয় ভাষা জরিপ করেছিলেন। তারা ভাষার ক্ষেত্রে এই ধরনের কেন্দ্র-প্রান্তের ধারণা চাপিয়ে দেন নি। পাঁচশো বছর পূর্ব থেকেই যে ভাষা স্বতন্ত্র ভাষাপরিচয়ে সংজ্ঞায়িত, পাঁচশো বছর পরে সেটা বাংলার উপভাষা হওয়ার ছাঁচ ঔপনিবেশিক, পূর্বতসিদ্ধ এবং আরোপিত।
যে জ্ঞানমন্দিরে বসে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, সেটি ঔপনিবেশিক জ্ঞানোৎপাদনের কারখানা। তার জ্ঞান-কারিগর ঔপনিবেশিক প্রভু, জোয়ালি সুনীতিকুমার। এই প্রভাব, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, এমনকি প্রজ্ঞাবান আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকেও নিস্তার দেয় নি।
ভাষার চর্চা যে এক ধরনের ভাষাবিজ্ঞানে রূপান্তরিত হচ্ছে, তার সূত্রধার ম্যাক্স মুলার। তিনি তার 'সায়েন্স অব ল্যাংগুয়েজ' বইতে ভারতীয় ভাষা নিয়ে লিখেছেন। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভেন্টদের উদ্দেশ্যে ভারতীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি ভাষার কিছু রূপ ব্যাখ্যা করেছেন। সেখানে ভাষার মিল অমিল এবং বৈচিত্র্যের ওপর আলোকপাত করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন একটি দুইটি ভাষার মধ্যে কোনটিকে মূল এবং কোনটিকে উপভাষা গণ্য করা হবে, তা একান্তই শব্দের মূলের ওপর নয়, শব্দের ঐতিহাসিক প্রবাহ, ব্যবহার এবং ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। কাজেই চাটগাঁইয়া ভাষাকে উপভাষা বলাটা যতো না ভাষাতাত্ত্বিক বিষয়, তার চেয়ে বেশি ঔপনিবেশিক ক্ষমতা চর্চার বিষয়। ক্ষমতার কেন্দ্র-প্রান্তের ধারণা এবং তার চর্চার বিষয়।
📝লিখেছেন:
কোন মন্তব্য নেই